Author

কবি তারক চন্দ্র সরকার

মহাকবি তারক চন্দ্র সরকার শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত গ্রন্থ লিখেছেন।

তারক সরকার। তাঁকে কবি, কবিয়াল, মহাকবি, রসরাজ, তারক ভাগবত ইত্যাদি বলা হয়ে থাকে। জন্ম তাঁর যশোর জেলার জয়পুরে ১২৫৪ সনের আষাঢ় মাসে। পিতা কাশীনাথ ছিলেন কবিয়াল।

 

বাল্যকালঃ

যেমনটা কবিয়ালদের হয়ে থাকে, কাশীনাথের গানে প্রবল টান ছিলো। ঢাকা হোক কিংবা কলকাতা, কাশীনাথ নানান স্থানে যেতেন। তারক সরকারের পিতা বছরের অধিকাংশ সময় গ্রামের বাইরে অবস্থান করতেন। মায়ের যত্নেও ভালোবাসায় জয়পুর গ্রামের নবগঙ্গা নদীর উত্তর তীরে তারক সরকার বেড়ে ওঠেন। ছোট বেলায় তার মধ্যে অসম্ভব মেধা ও বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। আর এই গান-সাহিত্য-কবিতা-ছন্দের ভুবনে কাশীনাথের কোলে যেন আর এক প্রতিভার আবির্ভাব হয়। পাঁচ বছর বয়সে তারক কাব্য গাঁথা রচনা করেন।

 

শিক্ষা ও কবিগান শিক্ষাঃ

পাঠশালায় অতি স্বল্প সময়ে ক্রমে বর্ণশিক্ষা ও যুক্তবর্ণ শেষ করেন। আদিপাঠ শেষে দ্বিতীয় মানের পড়া শিখে শিক্ষকসহ সকলকে বিস্মিত করে মাস’ছয়েকের মধ্যে তারক গানের হাতেখড়ির জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত হয়ে ওঠেন। অন্তত তাঁর পিতা তো তাই মনে করতেন। আর সে জন্যই পিতার নির্দেশে লেখা পড়া ছেড়ে তারক কবিগানে প্রবেশ করেন।

তারকের কবিগান শিক্ষা ও কবিগানের প্রতি অনুরাগ জন্মে ছিলো তার পিতার কাছ থেকে। পিতার আন্তরিকতাই তিনি কবিগানে প্রয়োগ করেছিলেন। কবিগান শিক্ষার বিষয়টি তিনি গ্রহণ করেছিলেন পিতা কাশানাথ সরকারের কাছ থেকে। তবে পরবর্তিতে তাঁর ধর্মীয় গুরু মুত্যুঞ্জয় তারককে কবিগান শিক্ষার ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহিত করেন।

তারক এবার পড়তে পারেন। তাই একে একে ভাগবত, রামায়ণ, গীতা, স্মৃতি, পুরাণের আঠারো খণ্ড পড়ে শেষ করেন। আকণ্ঠ রসপানেও যেন ক্ষুধার নিবৃত্তি হল না। তাই মনোকামনা পুর্ন করতে চৈতন্য চরিতামৃতের প্রেমরসে ডুব দিলেন। আর দিবারাত্রি ছেলের অমনতর আগ্রহে আশাবাদী পিতা সুখে নিদ্রা যায়।

 

পিতার মৃত্যুঃ-

তারক সরকার ১৫ বছর বয়সে তাঁর পিতাকে হারান। পারিবারিক প্রয়োজনে নিরুপায় তারককে পিতার জীবিকার পথে হাঁটতেই হল। কিন্তু এ তো সাধারণ জীবিকার পথ নয়। কবি-ছন্দ-সাহিত্যের সাধনায় মগ্ন না হলে এবং অন্যকে তা দিয়ে আকৃষ্ট করতে না পারলে এপথে এগোনো সম্ভব নয়। তারক সরকার তাঁর পিতার পথের যোগ্য সাধক। তবে শুরুটা ভালো ছিলো না।

বালক মনঃপ্রাণ দিয়ে কবিগান গাচ্ছে। কিন্তু সে গানে লোকজন তেমন সাড়া দিচ্ছে না। কোনোখান থেকে গাইবার কোনো প্রস্তাব তাঁর কাছে আসছে না। বালকের মন ভেঙ্গে গেলো।

 

মৃত্যুঞ্জয়ের সাথে সাক্ষাৎঃ-

বালক তারক পিতার গানের দলের হাল ধরেছে। কিন্তু বেহাল দশা থেকে কিকরে কাটিয়ে ওঠা যায় তা এখুনি তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছে। পিতার দলের দোঁহার সূর্যনারায়ণ হয়তো কিছু বলতে পারবেন। দুর্দশার পরিত্রাণের জিজ্ঞাসায় সূর্যনারায়ণ তারককে মৃত্যুঞ্জয় সাধুর কাছে যেতে বলেন। অদূরেই কালীনগরে মৃত্যুঞ্জয়ের ঘর। নমঃশূদ্র বংশের এমন বলশালী চেহারার খুব একটা চোখে পড়ে না। বালক কবি সূর্যনারায়ণকে সঙ্গে নিয়ে কালীনগরে মৃত্যুঞ্জয়-এর বাড়িতে যান।

মৃত্যুঞ্জয় সাধুকে গুরু সম্বোধন করে বালক কেঁদে কেঁদে দুরাবস্থার কথা বললে বালকের প্রতি দয়াপরবশত তিনি সাহায্য করবার ইচ্ছা পোষণ করেন। এবং তাঁর সাথে পরে দেখা করতে বলেন।

পরে এক দিন মৃত্যুঞ্জয়ের সাথে দেখা করতে গেলে তারক তাঁর কাছে হরিচাঁদ ঠাকুরের কথা শোনেন। তারককে মৃত্যুঞ্জয় ওঢ়াকান্দি যাবার পরামর্শ দেন।

কিন্তু বালকের মনে গুরু হল মৃত্যুঞ্জয়। তারক ওঢ়াকান্দি যাবার কোনো প্রয়োজন দেখে না।

এই ভাবতে ভাবতে পুনরায় তাঁর নিকট গেলে তারককে মৃত্যুঞ্জয় বুঝিয়ে বলেন ও মনের সন্দেহ ঝেড়ে ফেলে ওঢ়াকান্দি যেতে বলেন। ২ দিন পর তারক ওঢ়াকান্দি যাত্রা করেন।

 

হরিচাঁদ ঠাকুরের সাথে সাক্ষাৎঃ-

ওঢ়াকন্দিতে পৌঁছুলে হরিচাঁদ ঠাকুর মৃত্যুঞ্জয়ের সাথে তারককে দেখে আনন্দিত হন। ঠাকুরের উৎসাহে, ঠাকুরের মহানুভবতায় প্রভাবিত হয়ে গদগদ তারক ঠাকুরের সম্পর্কে শ্লোক রচনা করেন। তন্মধ্যে একটি ছিলো এমন:-

তরুণ-আরুণ      কোমল- করুণ
কম-কান্তি কৃপাময় ।
বুদ্ধ-মুর্ত্তি ধরে'      শুদ্ধোধন ঘরে
রাজপুত্র রাজালয় ।।
প্রেম পবিত্রতা      অহিংসা-বারতা
হানা'লে জগত-জনে ।
ভাই ভাই তাই      ভিন্ন ভাব নাই
পরম পীরিতি প্রাণে ।।

স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, ঠাকুরের মানবীয় গুণাবলীর প্রতি তারক বেশ আকৃষ্ট হয়েছিলেন। অতি চমৎকার স্তবে তারক দয়াময় হরিচাঁদ ঠাকুরের গুণের কথা ও মানবতার কথা কবিগানের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে মগ্ন হতে থাকলেন।

মহাকবি তারক সরকার হরিচাঁদ সান্যিধ্যে এসে সব ধরনে বৈদিক ক্রিয়া কর্ম ছেড়ে দিয়েছেলেন।

তন্ত্র, মন্ত্র, দীক্ষা শিক্ষা করিলেন ত্যাগ ।
শুধু হরিচাদে রাখে দৃঢ় অনুরাগ ।।

তারক হয়ে গেলেন শ্রীতারক গোঁসাই।

কিন্তু তারকের গান কেউ শুনতে চায় না কারন তাঁর কন্ঠে সুর নেই। একথা জেনে হরিচাঁদ তাঁকে হাটে-বাজারে নিজের এই দুরবস্থার কথাকেই সুরে সুরে গাইতে পরামর্শ দেন। কথা মত তারক সরকার গান গেয়ে যান। যেন পাষাণ গলে গজ হল। এবার লোকে তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর খ্যাতি সবখানে ছড়িয়ে পড়লে ঢাকা থেকে তাঁর ডাক এলো। পরিস্থিতিটা নতুন। তারকের ভয় হল। বলেকয়ে ঠাকুর তাঁকে সাহস যোগান।

 

খ্যাতি-সম্মান-উপাধিঃ-

যথারীতি ঢাকায় পৌঁছলেন তারক সরকার। গানের সভায় গিয়ে দেখা গেল, বিপক্ষ কবি সরকার তারকের থেকে অত্যন্ত জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ। এ যেন তারকের নিশ্চিত পরাজয়। তবে এই দুই কবি সরকারের গানের লড়াইয়ে আমাদের নবীন কবির কাছে অভিজ্ঞ কবি সরকার পদে পদে হেরে গেলেন। দলের প্রবীণ দোঁহার সূর্যনারায়ন ও তারকের গানে সভাসুদ্ধ লোক মুগ্ধ হয়ে গেলো। এমনকি বিপক্ষ দলের কবি গান গাইতে এলেও লোকে তারকের গান শুনতে ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে পড়ছে।

দেশে দেশে তারকের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে কৌতূহলী কিছু ব্রাহ্মণ পণ্ডিত তাঁকে পরীক্ষা করলেন। তারা কবি তারক সরকারে কাছে কিছু কঠিন প্রশ্নের উত্তর জানতে চান। কিন্তু কবি তারক সেই প্রশ্নের জবার খুব সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করে বোঝান। তাতে ব্রাহ্মণ মন্ডলী খুব খুশি হয়ে তাঁকে ''শ্রীতারক ভাগবত" উপাধি দেন।

তারক সরকার মতুয়া উপম্প্রদায়েরও একজন গুরু ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে কবিগান পরিবেশন করেছিলেন। তারক সরকার কবিগানের বিভিন্ন উপাঙ্গ রচনা করে দুই বাংলার কবিয়ালদের নমস্য হয়েছিলেন। আজও তার রচিত ডাক, মালসী, ভবানীবিষয়ক, কবিগান লোকমুখে ও আসরে পরিবেশিত হয়ে থাকে। তারক সরকার শুধু সার্থক কবিয়ালই ছিলেন না তিনি বাংলাদেশও বর্তমান পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন কবিগানের আসর সৃষ্টি করে কবিগানের স্থায়ীত্বের জন্য যে কাজ করেছেন তার কোনো তুলনা হয় না। সার্থক কবিয়াল তারক সরকারকে কালিয়ার পন্ডিতসমাজ ‘কবিরসরাজ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তারক সরকারের সার্থক কবিয়াল শিষ্য গোপালগঞ্জের দুর্গাপুর গ্রামের মনোহর সরকার। এই কবিয়াল মনোহর সরকারের শীষ্য হলেন যুগান্ধর কবিয়াল বিজয় সরকার। কবিগান ছাড়াও তারক সরকারের রচিত দুইখানি গ্রন্থ মতুয়া সমাজের অতি প্রয়োজনীয়। এই দুই গ্রন্থ হলোঃ ১. হরিলীলামৃত ও ২. হরিসংকীর্তন।

 

পশুর প্রতি ভালোবাসাঃ-

গৃহ-পালিত পশুদের প্রতি, বিশেষ করে গরুর প্রতি তাঁর যত্ন-ভালোবাসা যেন বেশি। একবার তিনি একজনের কাছে একটি গরু বিক্রয় করেন। গরুর বর্তমান মালিক গরুটিকে হাল চাষে নিয়ে এলো। অদূরেই তারক হেঁটে যাচ্ছিলেন। তখন গরুটি তাঁর পুর্ব মালিক অর্থাৎ তারককে চিনতে পেরে তাঁর কাছে দৌড়ে ছুটে আসে। এমতাবস্থায় গরুর ক্রেতা গরুটিকে তারকের নিকট ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। পশুরা মুখের কথা বোঝে না, বোঝে ভালোবাসা। তারক গান গেয়ে বাড়িতে ফিরে এলে গরুগুলি যেন দঁড়ি ছিঁড়ে তারকের কাছে আসতে চায়, ভালোবাসার টানে।

 

মহাপরিনির্বাণ:-

কবিয়াল তারক সরকার ১লা অগ্রহায়ণ ১৩২১ সনে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। কবিয়াল তারক সরকারের "স্বপ্ন বিলাস" কবিগানের অংশ বিশেষ এখানে উদ্ধতি করা হলঃ-

‘নিশীথে স্বপ্নাদেশে নন্দরাণী নন্দ রাজার কাছে কেঁদে বলতেছে

নন্দ বলবো কী আমি দুখিনী।।

শেষ নিশীথে দেখেছি স্বপন, শুনো জানাই স্বপ্নের বিবরণ

হায় গো তোমায় কী বলবো নন্দ, পেয়েছিলাম প্রাণগোবিন্দ

হলো কি আনন্দ, কপাল মন্দ-

আমার সে আনন্দ বিসর্জন।।

 

কোলে পেয়ে শ্যামত্রিভঙ্গ হেলায় নিন্দ্রাভঙ্গ

আজ নিশীতে দেখতে দেখতে সেই চন্দ্রবদন আর দেখলাম না।।

নন্দ নিশির শেষে দেখেছি স্বপ্নাদেশে প্রাণের কেলেসোনা।।

 

আমার বক্ষের ধন, এই ক্ষণ কোলে বসে মা বলে খেলতেছিল মেতে

হেসে হেসে পেয়ে সেই কালো রতন, করলেম না যতন

মনের মতো দেখতে দেখতে সেই চন্দ্রবদন

আর দেখলেম না।।

 


 

তারক সরকারের জন্ম তারিখ নিয়ে কয়েক স্থানে ভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। ইন্টারনেট ওয়েব পঞ্জিকাতে জন্ম তারিখের সাথে তিথি, বার মিলছে না।

যাই হোক, এখানে তারক সরকার সম্পর্কে যে তথ্য দেয়া হয়েছে সেসবের তথ্যসূত্র নিচে উল্লেখিত হল।


 

http://jessore.info/index.php?option=content&value=1033


 

(Source: BOOK- “ঠাকুর শ্রী শ্রী হরিচাঁদ মানব পুরুষঃ অধ্যাত্ম পুরুষ” পৃঃ সংখ্যা – ২৭৮)

তারক সরকার ১৮৪৫ সালে যশোর জেলার জয়পুরে জন্মগ্রহন করেন।

পিতার নামঃ- কাশীনাথ । তিনি কবিয়াল ছিলেন ।


 

(Source: BOOK- “শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত”, পঞ্চম সংস্করণ পৃঃ- ৩১১)

বারশ' চুয়ান্ন সালে আষাঢ় মাসেতে ।

জন্ম নিল শ্রীতারক প্রভু আজ্ঞামতে ।।

তেরশ' একুশ সালে মার্গশীর্ষ কালে ।

শ্রীতারক ছাড়িলেন এই ধরাতলে ।।

*** *** ***

মার্গ শীর্ষ শেষভাগে তারিখ একুশে ।

কায়া ছাড়ি গোস্বামীজী চলে নিজ দেশে ।।


 

(Source: BOOK- “শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত” প্রথম প্রকাশ পৃঃ- ৩৬)

মার্গ শীর্ষ অমাবশ্যে শনিবার দিনে।

তোর মাতা প্রসব করিল শুভক্ষণে।।

নাম করণেতে নাম রাখিল তারক।


 

(Source: BOOK- “শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত”, পঞ্চম সংস্করণ পৃঃ- ২৮৬-২৯৬)

ঢাকা কিংবা কলিকাতা কাশী যায় যথা তথা

গানে মত্ত ছিল দিন রাত ।

*** *** ***

পঞ্চম বরষ কালে   বসিয়া পিতার কোলে

কাব্য গাঁথা করিল রচনা ।

*** *** ***

ক্রমে বয়ঃবৃদ্ধি হয়   পাঠশালে তাঁরে দেয়

বর্ণশিক্ষা হ'ল একদিনে ।

সংযুক্ত বর্ণের লেখা     শিক্ষা করে একবেলা

বিস্ময় মানিল সবে মনে ।।

আদি পাঠ দিল তাঁরে তিন দিনে শেষ করে

প্রথম মানের শিক্ষা যত ।

দ্বিতীয় মানের পড়া   সপ্ত দিনে হ'ল সারা

পন্ডিতেরা হ'ল বাক্য-হত ।।

এই ভাবে ছয় মাসে   শিখিলেন সবিশেষ

চাত্রবৃত্তি পাঠ যাহা ছিল ।

কাশীনাথ বলে তাই     আর পড়ে কার্য নাই

কবি গান-শেখা এবে ভাল ।।

ভাগবত রামায়ণ   করিলেন অধ্যায়ন

আর পড়ে শ্রীমহাভারত ।

গীতা পড়ে স্মৃতি পড়ে যখনে যে পাঠ ধরে

একেবারে করে কন্ঠ-গত ।।

আঠার পুরাণ পড়ে     হেনকালে মনে পড়ে

চৈতন্য চরিতামৃত নাম ।

সে গ্রন্থ আনিল ত্বরা     দেখে প্রেমরসে ভরা

এতদিনে পূর্ণ মনস্কাম ।।

দিবারাতি পড়ে গ্রন্থ কভুনাহি করে ক্ষান্ত

ভাব দেখি সুখী কাশীনাথ ।

*** *** ***

পঞ্চদশ বর্ষ যবে         তার বয়ঃক্রম হবে

নিয়তির অলঙঘ্য নিয়মে ।

ছাড়িয়া সংসার-মায়া     সাজিয়া নশ্বর কায়া

কাশীনাথ গেল স্বর্গধামে ।।

একা ঘরে নিরুপায়   ঠেকিয়া বষম দায়

সে তারক করিল কল্পনা ।

পিতৃ-ব্যবসায় ধরি     আমি কবি গান করি

তাই হোক আমার সাধনা ।।

পিতার "দোঁহার" যত   সবে করি হস্তগত

মনোমত কবি গান গায় ।

দেখিয়া বালক-প্রায়     কেহ নাহি ডাকে তায়

মনোদুঃখে বুক ফেটে যায় ।।

*** *** ***

দূরে নহে তাঁর ঘর       থাকে সে কালীনগর

নাম তাঁর সাধু মৃত্যুঞ্জয় ।

তাঁর মত শক্তিশালী       নমঃশূদ্র বংশাবলী

মধ্যে অন্যে দেখা নাহি যায় ।।

*** *** ***

প্রকাশ্য তারক বলে           সূর্যনারায়ণ-স্থলে

"শোন সূর্য! আমার মনন ।

সে কালীনগরে যা'ব   তোমাকেও সঙ্গে নি'ব

মৃত্যুঞ্জয় করি দরশন ।।

*** *** ***

মৃত্যুঞ্জয় বলে "তুই শোন মোর সোনা ।

অদ্য হ'তে মম হাতে তুই হ'লি কেনা ।।

বাসনা পূরিবে তোর নাহি কোন ভয় ।

বল দেখি কি বলিতে এলিরে হেথায় ।।"

তারক কান্দিয়া বলে "গুরু তুমি মোর ।

দয়া করে কাট যত মায়া-মোহ-ঘোর ।।

নিজ গুণে দয়া যদি করিয়াছ প্রভু ।

চরণ ছাড়িয়া আমি নাহি যাব কভু ।।

হেসে তায় মৃত্যুঞ্জয় বলে মিষ্টভাষে ।

"শুক্তি পেয়ে ভুলে গেলি রত্নাকরে এসে ?

যাও বাছা গৃহে যাও এসো পুনর্বার ।

ক্রমে ক্রমে হ'বে জানা সব সমাচার ।।"

*** *** ***

*** *** ***

প্রনাম করিল গিয়া গোস্বামীর পায়।

হাসি হাসি মৃত্যুঞ্জয় তারে ডেকে কয়।

"তারক হে! তুমি নাহি জান সমাচার ।

ওড়াকান্দী হরিচাঁদ হরি-অবতার ।।

মোর যাহা কিছু দেখ সবি তাঁর কৃপাছায়া ।

জনম সফল যদি করিবারে চাও ।

সময় থাকিতে তুমি ওড়াকান্দী যাও ।।

*** *** ***

*** *** ***

মোর পক্ষে ভগবান গুরু মৃত্যুঞ্জয় ।

তাঁর পদে মন মোর যেন সদা রয় ।।

কাজ নাই ওড়াকান্দী হরিচাঁদে দেখে ।

সদয় আমাতে যদি প্রভু মোর থাকে ।।

*** *** ***

*** *** ***

পুনঃরায় তবে যায় সে কালীনগরে ।

মৃত্যুঞ্জয় হাসি তবে বলিল তাহারে ।।

''হে তারক! আর কেন মনেতে সন্দেহ ?

এক মনে এই বারে মোর বাক্য লহ ।।

দূরে থেকে যে কল্পনা সে সব অলীক ।

ওড়াকান্দী গেলে তুমি সব পাবে ঠিক ।।

সন্দেহ-ভঞ্জন হরি আছে ওড়াকান্দী ।

চল এক সঙ্গে মোরা সেই পদ বন্দি ।।"

এ মত কহিল যদি প্রভু মৃত্যুঞ্জয় ।

তারক স্বীকার করি পড়ে তাঁর পায় ।।

দুই দিন পরে দোঁহে করে শুভযাত্রা ।

*** *** ***

হেন-মতে ওড়াকান্দী হইল উদয় ।

চক্ষে জল মৃত্যুঞ্জয় হরি ! হরি ! কয় ।।

স্পর্শ মাত্রে শ্রীধামের পবিত্র প্রাঙ্গণ ।

অকস্মাৎ উচাটন তারকের মন ।।

প্রাঙ্গণের প্রান্তভাগে চটকা তলায় ।

মহাপ্রভু বসিয়াছে ছিন্ন-কন্থা গায় ।।

*** *** ***

যবে মৃত্যুঞ্জয় আসি উপনীত হ'ল ।

হাসি হাসি মহাপ্রভু কহিতে লাগিল ।।

'ওরে গোলক ! হীরেমন ! তরা দেখে যা ।

মিত্যুনে' এনেছে সাথে এক তোতার ছা' ।।

*** *** ***

প্রভু কয় "মৃত্যুঞ্জয় ! এই তোতার ছা' ।

আর কারে দিবে তুই মরে দিয়ে যা ।

*** *** ***

মহাপ্রভু ডেকে বলে, "তবে তাই হোক ।

যা' বলি তোতারে আমি সেই বুলি কো'ক ।।'

এ সময়ে তারকের কিছু চিত্ত স্থির ।

দর দর ধারে দুই চক্ষে বহে নীর ।।

যেই মাত্র প্রভু বলে "সেই বুলি কো'ক ।

তারকের জিহ্বাগ্রে আম্নি ফুটিল শ্লোক ।।

অপলকে শ্লোকে শ্লোকে করিল বন্দনা ।

মৃত্যুঞ্জুয় আনন্দিত শুনিয়া রচনা ।।

*** *** ***

তরুণ-আরুণ         কোমল- করুণ

কম-কান্তি কৃপাময় ।

বুদ্ধ-মুর্ত্তি ধরে'         শুদ্ধোধন ঘরে

রাজপুত্র রাজালয় ।।

প্রেম পবিত্রতা         অহিংসা-বারতা

হানা'লে জগত-জনে ।

ভাই ভাই তাই     ভিন্ন ভাব নাই

পরম পীরিতি প্রাণে ।।

*** *** ***

প্রভুর দয়ার গুণে বলিহারি যাই।

কৃপা-গুণে শ্রীতারক সাজিল গোঁসাই ।।

পিতৃ-ব্যবসায় তাঁর ছিল কবিগান ।

মনে ইচ্ছা সেই পথে করিবে প্রয়াণ ।

তাহে বিধি বাদী হ'ল কন্ঠে নাহি সুর ।

গান-ক্ষেত্রে গেলে সবে করে 'দূর দূর' ।।

*** *** ***

প্রভু বলে"রে তারক কোন চিন্তা নাই ।

আমি যাহা বলি বাপু ! তুমি কর তাই ।।

হাটে হাটে সাতহাটে বল সকলেরে ।

"সুর নাই দেখে সবে দূর করে মোরে ।।"

একার্য করিলে তুমি ফলিবে সুফল ।

গলিবে তোমার বাক্যে পাষাণে ও জল ।।"

*** *** ***

প্রভু-আজ্ঞা মতে কার্য করিল সুধীর ।

কন্ঠে সুর হ'ল তাঁর মধুর গম্ভীর ।।

পরে যত গান করে সেই মহা সাধু ।

সবে বলে "শুনিলাম মধু হ'তে মধু ।।

*** *** ***

ধন্য কবি শ্রীতারক কহে সর্বজনে ।

দেশে দেশে সবে ডাকে গানের কারণে।।

একবার ডাক হ'ল ঢাকার জিলায় ।

*** *** ***

নির্দিষ্ট তারিখে হ'ল ঢাকায় উদয় ।

বহু লোক সমারোহ গানের খোলায় ।

*** *** ***

বিপক্ষ নায়ক যিনি কবি সরকার ।

গানে, শাস্ত্রে, সর্বভাবে বহু শিক্ষা তার ।।

মনে মনে ছিল তাঁর গর্ব অতিশয় ।

নিশ্চয় তারকচন্দ্রে দিবে পরাজয় ।।

*** *** ***

অন্যপক্ষে সরকার পদে পদে হারে ।

তারকের দলে ছিল প্রবিণ 'দোহার'।

সূর্য নারায়ণ আর ভোলা সাথে তাঁর ।।

উভয়ের কন্ঠে যেন পিকরাজ জিনি ।

সভা শুদ্ধ হ'ল মুগদ্ধ সেই স্বর শুনি ।।

*** *** ***

এই ভাবে সারা রাতি গানের আসরে ।

মন্ত্র-মুগদ্ধ মত থাকে যত নারী নরে ।।

এমনি হইল দশা অত্যাশ্চর্যময় ।

বিপক্ষে নায়ক যবে আসিল সভায় ।।

সবে বলে "শীঘ্র শীঘ্র তুমি সেরে যাও ।

অপর দলের গান শুনিবারে দাও ।।

*** *** ***

*** *** ***


 

(Source: BOOK- “শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত”, পঞ্চম সংস্করণ "তারক ভাগবত” (পৃঃ ৩০০)

শ্রেষ্ঠ কবি বলে হ'ল তারকের নাম।

দেশে দেশে সবে তারে ডাকে অবিরাম ।।

ব্রাহ্মণ পন্ডিত কিবা রাজার সভায় ।

বহু -শাস্ত্র-বেত্তা বলি তাঁর পরিচয় ।।

এবে কহি সর্ব জনে অপূর্ব ঘটনা।

করিল অপূর্ব লীলা তারক রসনা ।।

নড়াইল রাজবাড়ী করির আসরে ।

ব্রাহ্মণ পন্ডিত বসে সভা শোভা করে ।।

বিপক্ষ দলের যিনি ছিল সরকার।

কোন গুণে তারকেরে হ'তে নারে পার ।।

ব্রাহ্মণ পন্ডিত তাহে হ'ল কুতূহলী ।

তারকে পরীক্ষা করে ব্রাহ্মণ মণ্ডলী ।।

*** *** ***


 

(Source: BOOK- “দয়ার সাগর তারকচন্দ্র”, পঞ্চম সংস্করণ পৃঃ ৩০৫)

গৃহের পালিত পশু ছিল যত গুলি ।

সকলে তারকে চেনে শোনে তার বুলি ।।

গরু গুলি তাঁরে দেখে বড় সুখপায় ।

আনন্দে নয়ন মুদে' হস্ত দিলে গায় ।

তারকের স্পর্শ পেতে সকলের আশা ।

তারকের কাছে তারা চায় ভালবাসা ।।

*** *** ***

গান করিবারে যবে বিদেশেতে যায় ।

'হাম্বা' রব করে গাভী চারি দিকে চায় ।।

*** *** ***

গান গাহি যেই কালে ফিরে আসে ঘরে ।

আনন্দের মাত্রা যেন কোথা নাহি ধরে ।।

দড়ি ছিড়ি গরুগুলি আসিবারে চায় ।

মুখের 'গেরাস' ফেলে বিড়াল দৌড়ায় ।।

*** *** ***

দরদী বান্ধবে দেখি মন নাহি মানে ।

হাল ভেঙ্গে চলে ছুটে প্রভুর সদনে ।।

'হাম্বা' 'হাম্বা' রব করে চক্ষে বহে জল ।

ভাব দেখে তারকের দেহে নাহি বল ।।

তারকের গাত্র গরু চাটিতে লাগিল ।

তাহা দেখি গোস্বামীর হৃদয় ফাটিল ।।

*** *** ***

যে-টাকা দিয়াছ তুমি লহ তাহা ফিরে ।

দয়া করে ছেড়ে দাও গরুটি আমারে ।।

*** *** ***

গরুরে উদ্ধার করি তারক চলিল ।

সেই গরু তারকের সঙ্গে সঙ্গে গেল ।।

 

*** *** ***

অল্পক্ষণে উপস্থিত বালকের বাড়ী ।

বসিবারে এনে দিল দুইখানা পীড়ি ।।

গৃহ মধ্যে কথা কয় বালকের মাতা ।

বাহিরে গোস্বামী বসি শোনে সেই কথা ।।

গোস্বামী ডকিয়া বলে সেই রমণীরে ।

"মাগো! কথা বল না'ক আসিয়া বাহিরে ।।

আমি ত তোমার পুত্র তুমি ও জননী ।

কাছে এসে বল কথা প্রাণ ভরে' শুনি।।"

গোস্বামীর কথা শুনি নারী কেন্দে কয় ।

"বাহিরে আসিতে বাবা নাহিক উপায় ।।

জির্ণ দীন বস্ত্র-হীন আমি আভাগিনী ।

মোর দিন কাটে বাবা পরে' এক কাণি ।।

শত ছিন্ন বস্ত্রে করি লজ্জা নিবারণ ।

কেমনে বাহিরে আসি বল বাপধন ।।

তোমার গুণের কথা সর্ব দেশে কয় ।

দীনজনে ধনী হয় তোমার কৃপায়।।

'নাড়ী-ছেঁড়া-ধন' মোর এক মাত্র ছেলে ।

স্বর্গে চলে গেছে স্বামী বালকেরে ফেলে ।।

দয়া করে আশীর্বাদ কর তুমি তারে ।

আর কষ্ট তার যেন না হয় সংসারে ।।

এই লাগি' কষ্ট দিতে এনেছি ডাকিয়া ।

কাঙ্গালেরে আশীর্বাদ কর মন দিয়া ।।"

এই কথা বলে নারী ফুকারিয়া কান্দে ।

বড়ই বাজিল ব্যথা সে তারকচাঁন্দে ।।

আপনার উত্তরীয় করি পরিধান ।

নিজবস্ত্র রমণীরে করিলেন দান ।।

যত অর্থ ছিল সাথে সব তারে দিল ।

প্রাণ ভরে সে-বালকে আশীষ করিল ।।

গোস্বামীর আশীর্বাদে সে দীন বালক ।

ধন পেয়ে ভবিষ্যতে হয় ধনী লোক ।।

"দীন বন্ধু" সে তারক দীনের সহায় ।

কত জনে করে দয়া তুলনা কোথায় ?


 

(Source: BOOK- “শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত”, পঞ্চম সংস্করণ "তারক ভাগবত” (পৃঃ ৩০৬)

তন্ত্র, মন্ত্র, দীক্ষা শিক্ষা করিলেন ত্যাগ ।

শুধু হরিচাদে রাখে দৃঢ় অনুরাগ ।।


 

তথ্য সংগ্রহে ও গোছানোয়ঃ
জগদীশ রায়।

লিখন ও পরিবেশনায়ঃ
কৌশিক রায়।